মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকার অনুমোদিত অনলাইন গণমাধ্যম
BD.GOV.REG.NO-88

মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকার অনুমোদিত অনলাইন গণমাধ্যম
BD.GOV.REG.NO-88

আপনি পড়ছেন : শিল্প-সাহিত্য

মানুষ ধরো, মানুষ ভজো

ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ

DhakaReport24.com || 2019-11-24 17:44:00
 মানুষ ধরো, মানুষ ভজো

ভজার সাথে পথে দেখা। আমাদের পাড়ার নেতার বাড়িতে থাকে। ছোটবেলা থেকে চিনি। ও-ও চেনে আমাকে। ও জানে আমি একটু পাগলাটে, একটু এলোমেলো। পথেঘাটে দেখলে ভজা আগে ভরকাত। আগে তো আমরা ক্ষমতাধর ছিলাম। আগে আমার বাবা নেতা ছিলেন। এখন ভজার কর্তা নেতা। এখন সে খুব ক্ষমতাধর। এখন আর ভরকায় না, বরং রাগী রাগী মুখ করে ভজা চোখ পাকিয়ে তাকায়। তার এই হামবড়া আমার ভালো লাগে না। যে কারণে আজ একটা রিস্ক নিয়েই নিই। ভজাকে একটু দূর থেকে খুব তরল গলায় ডাকি।
‘‘ও হে ভজা, কর্তাও ভজলি, ঈশ্বরও ভজলি, বলে দে তো, কোনটা সহজ।’ ভজা বলে, ‘কাছে আও, কানে কই, ধীরে কই!’’
কাছে গেলে ভজা জ্ঞান দেয়ার মতো করে বলে, ‘‘মানুষের পূজার চেয়ে ঈশ্বরে পূজাই বোধহয় সহজ ও নিরাপদ। যিনি মানুষ- তা সে আমার কর্তাই হোন আর মানব, দরবেশ, সন্যাসী, ঋষি, পীর, পুরোহিত, রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধান- যাই হোন না কেন, তিনিও তো থাকেন এই ধরাধামে। তাঁরও আছে নানা প্রতিক্রিয়া-বিকার, নানা মেজাজ-মর্জি। কখন ধমক দেবেন, কখন ধাক্কা দেবেন, কখন বর দেবেন আর কখন অভিশাপ দেবেন তার কোনো ঠিক নেই তো বাপু। ঈশ্বরই ভালো। ঈশ্বরের কোনো বিকার নেই। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ঈশ্বর আকারেই থাকুন কিংবা নিরাকারে- তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান না, দেখাতে পারেনও না হয়ত! চোর যখন প্রার্থনায় বসে বলে, ঈশ্বর, রাতে যেন ধরা না পড়ি, ঈশ্বর কিন্তু তখন তাঁর গালে কষে থাপ্পড় দেন না। সাধু যখন আরো সাধু হওয়ার প্রার্থনা করে ঈশ্বর কিন্তু তখন তাঁকে বুকেও টেনে নেন না। চোর-সাধু দুজনেই ইচ্ছেমতো মনে করতে পারেন, ঈশ্বর তাঁর প্রার্থনা শুনেছেন, তাঁর পূজায় সাড়া দিয়েছেন। যিনি মনে মনে এমন ভাবতে পারেন তিনিই কামিয়াব হন। যিনি ভাবতে পারেন না তার সফলতা বা সান্ত¡না­ কোনোটাই মেলে না।’’
‘‘কিন্তু ভজা, ঈশ্বরের পূজা সহজ ও নিরাপদ হলেও তো তাতে ফল মেলা কঠিন, কিন্তু মানুষের পূজায় ফল মেলে সহজে, একেবারে নগদে। ওই যে বলে না, মানুষ ভজিলে সোনার মানুষ হবি। তুই যেমন হলি আর কি!’’
ভজা বলে, ‘‘তা ঠিক! শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়, যেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করেন, সেভাবে মানুষের আরাধনা করতে থাকুন, তিন-সাত কিংবা তিরিশ দিনের মধ্যে হাতে হাতে ফল পাবেন। কিচ্ছু লাগবে না, এক্কেবারে শূন্য থেকেও শুরু করতে পারেন। শুধু যোগাযোগ রাখতে থাকুন, যোগাযোগ হয়ে গেলে দেখা-সাক্ষাৎ করতে থাকুন, সাক্ষাৎ হয়ে গেলে কথাবার্তা চালাতে থাকুন পূজনীয় মানুষটির মর্জিমতো। বিনয়ের সাথে প্রশংসা, সেবা ও তেলবাজি করতে থাকুন, তিন-সাত কিংবা তিরিশ দিনের মধ্যে মোক্ষম সুফল পাবেনই পাবেন।
‘‘একবার এক জনসমাবেশের মঞ্চে বসে ছিলেন আমার কর্তা, কর্তা তখন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। এক অর্বাচীন সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীর যা না তা প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। মন্ত্রী মহাশয় তাঁর পাশে বসা নেতাকে আস্তে করে বললেন, ‘কী রে, ও কী বলছে এসব, ওর মাথা ঠিক আছে তো। আমার এত প্রশংসা। এ তো মিথ্যা, বাড়িয়ে বলা। আমি কি এতকিছু করেছি? আমি কি এত মহান কেউ?’ পাশের নেতা ভাবলেন মন্ত্রী মহাশয় বিরক্ত হচ্ছেন। খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘লিডার, ওকে এখনই থামিয়ে দিচ্ছি।’ মন্ত্রী তাকে তড়িঘড়ি থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘না না, ওকে থামিও না, বলতে দাও, বলুক, আরো বলুক, বাড়িয়ে বলুক, ভুল বলুক, মিথ্যা বলুক, তাতে কী, আমার তো ভালো লাগছে।’’
‘‘তার মানে ভজা, ঈশ্বরভজনে লাজ-সংকোচ-ভয়-সংশয় কাজ করে না। মানুষ-দেবতার ভজনে আমাদের যত লাজ-সংকোচ-ভয়-সংশয়। তা না হলে মানুষ ভজাও খুব সহজ ছিল।’’
ভজা বলে, ‘‘অ্যাঁ, এই তো, আউলা মাথার মানুষ হয়েও এক্কেবারে ঠিক বুঝেছেন। ওই যে, বাউল-ফকিররা বলেন, ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে, পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে।’ না না, মানুষ ভজতে দিব্যজ্ঞানও লাগে না। এত সহজ যে মানুষ ভজা, সেই ভজনটাই অনেকে পারেন না। আপনিও পারলেন না।’’
‘‘ভজা, আমি জানি রে, যারা পারেন না তাদের মধ্যে আবার অন্য কী একটা যেন থাকে। মহাভারতের কর্ণের মতো কী এক অনমনীয়তা যেন, যা তাকে অন্যায্য নত হতে দেয় না। সেই অনমীয় মানুষগুলোর মধ্যেই আমি ঈশ্বরের চেয়েও বড় কাউকে দেখতে পাই রে ভজা, মানুষ-দেবতার চেয়েও বড় কাউকে দেখতে পাই। তাঁর পূজা করি না আমি। তাঁর পূজা করতে হয় না। পুজা করলে তিনিও হয়ত পটে যাবেন। আমি তাঁকে অন্তত পটাতে চাই না।’’
ভজা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে নাই বোধহয়! নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছে। ভজা আবার ভান-ভণিতা ও ঢংঢাংয়ে বড় ওস্তাদ। ভজার গালে ঠোনা মেরে আমি হাঁটতে হাঁটতে গান ধরি, ‘‘মানুষ ধরো, মানুষ ভজো, শুন বলি রে পাগল মন, মানুষ ধরো মানুষ ভজো, ও ভজা, মানুষ ধরো, মানুষ ভজো!’’